সময়ের আবর্তনে বছর ঘুরে আসে বাংলা নতুন বছর। এই নতুন বছরকে ঘিরে থাকে কতইনা আয়োজন! শহর কিংবা গ্রাম সকল জায়গায় সবাই মেতে উঠে বর্ষবরণ উৎসবে, আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। মেলাকে ঘিরে বসে আঞ্চলিক ও লোকগানের আসর, যাত্রাপালা, পুতুল নাচ। মেলায় আসে রংবেরঙের নকশা করা কত জিনিস আর নানা রকম খেলনা। মেলায় একটি বিশেষ আকর্ষণ হল নাগরদোলা। মেলায় পাওয়া যায় মুখরোচক অনেক খাবার যেমন- মুড়ি-মুরকি, খাজা-গজা, চিনির তৈরি হাতি, ঘোড়া, মাছ, পাখি আকৃতির নানা রকমের মিষ্টি। বৈশাখী উৎসব উদযাপনের জায়গাটিকে সাজানো হয় বিভিন্ন রঙিন দেশীয় জিনিস দিয়ে যেমন— কুলা, ডালা, মুখোশ, কাগজের ফুল, নানান রকম নকশা ও আলপনা করে। পরিবেশন করা হয় গান, নাচ, আবৃত্তিসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বর্ষবরণ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই চমৎকার গানটি দেওয়া হলো। পুরানো দুঃখ-বেদনাকে পেছনে ফেলে নতুনকে বরন করার, নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার আহবান রয়েছে গানটিতে।
এসো হে বৈশাখ এসো এসো,
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক এসো এসো।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুভাষ্প সুদূরে মিলাক।।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক যাক যাক।।
বৈসাবি, বিজু, বৈসু সাংগ্রাইন, চাঃক্রান পোই প্রভৃতি উৎসবের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উদ্যাপন করে থাকে।
আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি জুড়ে আলপনার রয়েছে বিশাল কদর। চালের গুড়াকে পানির সাথে মিশিয়ে বিভিন্ন ব্রত উপলক্ষ্যে আলপনা আঁকার প্রচলন আমাদের দেশে দীর্ঘ দিনের। তাছাড়া শখের হাড়ি, মাটির খেলনাসহ বিভিন্ন লোকসামগ্রীতে লোকশিল্পীদের সহজ সরল সাবলীল আলপনা আঁকার প্রচলন দেখা যায়। বিভিন্ন রকমের ফুল, লতা, পাতা, মাছ, পাখি হলো এই সব আলপনার মূল বিষয়বস্তু। তাছাড়া নানা রকমের ফোটা আর রেখার ব্যবহার ও দেখা যায় সেসব আলপনায়।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই লোকশিল্পরীতি ক্রমশ হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস থেকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সবত্রই লক্ষ করা যায় আলপনার বহুল ব্যবহার।
আগের পাঠে আমরা বিভিন্ন রেখার সাহায্যে নকশা তৈরি করা শিখেছিলাম। এবার আমরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক আকার যেমন- ফুল, লতা, পাতা, মাছ, পাখি এবং নানা রকম জ্যামাতিক আকার যেমন- ত্রিভূজ, চতুভূজ, বৃত্ত ইত্যাদি দিয়ে কি করে আলপনা আঁক যায় তা জানব।
বর্ষবরণে ব্যবহার করা নানা জিনিসে বা ক্ষেত্রে যে আলপনা ও নকশা খুঁজে পেলাম তাকে আগের পাঠে দেখে আসা নকশার সাথে মিলিয়ে দেখি। কাজটি জোড়ায়/দলে করতে পারি। নিজেদের দেখা আলপনাগুলো আমরা খসড়া আকারে এঁকে এবং তার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সকল তথ্য বন্ধুখাতায় লিখে রাখব। এবার খসড়াগুলো মিলিয়ে নিজের মতো করে একটি আলপনা বা নকশা আঁকার পালা। আলপনা বা নকশা আঁকার জন্য আমরা হাতের কাছে পাওয়া উপকরনকে প্রাধান্য দিব। তাছাড়া বিভিন্ন রঙ্গের কাগজ কেটে ঝালর বানিয়েও আমরা নানা রকমের নকশা তৈরি করতে পারি।
আলপনা আর নকশা সৃষ্টি করতে করতে এবার আমরা জানব বাংলার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের কথা। আর তাহলো পুতুলনাচ। বিভিন্ন ধরনের পুতুল বানিয়ে, সেগুলোকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নাচানোর মধ্য দিয়ে দর্শকের সামনে কোন একটি বিষয়কে উপস্থাপন করানোটাই হল পুতুলনাচ। ধাতু, কাপড়, ঘাস, শোলা, কাগজ, পাথর, মাটি, কাঠসহ কত বিচিত্র জিনিস দিয়ে তৈরী করা হয় পুতুলগুলো। চরিত্র অনুযায়ী রং বেরঙের সাজে তৈরি করে তাকে হাতের সাহায্যে নাচানো হয় সাথে সাথে পুতুলনাচের শিল্পীরা বিভিন্ন রকমের গলার স্বর করে পুতুলগুলোর চরিত্রগুলোকে প্রানবন্ত করে তোলে। আবার কোন কোন পুতুল নাচে মানুষ নিজে পুতুল সেজে নাচ করে।
স্বরের কথা যখন আবার আসলো, তাহলে চলো এবার আমরা একটা গানকরি এবং গানটির স্বরগুলোকে চিনি। গানটির সাথে যদি আমরা ইচ্ছেমতো পুতুলনাচের ভঙ্গি করে গানের ভাবটাকে ফুটিয়ে তুলি, কেমন হবে বলতো?
চলো এবার সবাই মিলে একটি গান করি -
সা তে সাঁতার কাটি মোরা সুরে
রে তে রেখা টেনে যাই বহুদুরে
গা তে গান গাই এস প্রান খুলে
মা তে মান্য করি গুরুজনে
পা তে পাঠশালা যাই নিয়মিত
ধা তে ধৈর্য ধরি পরিমিত
নি তে নৃত্যে ভঙ্গি শিখি পারি যত ।
যেভাবে আমরা গানটি গাইব-
খেয়াল করেছ এই গানটির মাঝেও আছে নকশা-সুরের নকশা !
“আশা করেছিলুম বিচিত্রা থেকে আমাদের দেশের চিত্রকলার একটা ধারা প্রবাহিত হয়ে সমস্ত দেশের চিত্তকে অভিষিক্ত করবে কিন্তু এর জন্য কেউ যে নিজেকে সত্যভাবে নিবেদন করতে পারলে না। আমার যেটুকু সাধ্য ছিল আমি তো করতে প্রস্তুত হলুম কিন্তু কোথাও ও প্রাণ জাগলনা। চিত্রবিদ্যা আমার বিদ্যা নয়, যদি তা হতো তাহলে একবার দেখাতুম আমি কি করতে পারতুম”।
কবি তার স্বপ্নকে বাস্তব রুপ দিতে ১৯১৯ সালের ৩ জুলাই শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেন ‘কলাভবন’ । চারু, কারু, নৃত্য, সংগীতসহ শিল্পের বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় ‘কলাভবন'।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাসসহ অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে আরেকটি অনন্য সৃষ্টি হলো তার চিত্রমালা। রবীন্দ্রনাথের ভাব আর আবেগের জগত ছিল তাঁর সাহিত্য। আর তাঁর রূপের জগত হলো ছবি আঁকার। লেখার মাঝে কাটাকুটির ছলে আঁকা ছবিগুলো ছিল শিল্পী রবীন্দ্রনাথের অমর চিত্রকলা। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা প্যারিস সহ ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রায় ১২টি শহরে প্রদর্শিত হয়েছিল। চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজয় হয়েছে এই চিত্র রাশির মধ্য দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে ভরে তুলেছিলেন তার সৃষ্টিকর্ম দিয়ে। শিল্পকলার এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যা রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতার স্পর্শ পাইনি। এতোদিন আমরা রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাসসহ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে জানতাম এবার আমরা বিশ্বজয়ী শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে জানলাম।
এবার নববর্ষ উদ্যাপন করব নিজেদের আঁকা আলপনা ও নকশা করে।
যা করব—
■ বৈশাখী উৎসব উদযাপনের জন্য আলপনা করার খসড়া পরিকল্পনা করে রাখতে হবে ।
■ কাগজ কেটে ঝালর বানাব।
■ দেশীয় সংস্কৃতির/ বর্ষবরণের নানান পরিবেশনা (নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি) চর্চা করব।
■ মঞ্চ ও স্থান সজ্জার জন্য আলপনা ও নকশা করব।
■ শ্রেণিকক্ষে মেলার/ উৎসব আয়োজন করব অথবা বিদ্যালয়ের আয়োজনে অংশগ্রহণ করব।
■ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টকর্ম সম্পর্কে আমরা আরও জানতে চেষ্টা করব।
Read more